মোঃ জাহিদ হোসেন<>আফরিন তখন নবম শ্রেণীতে পড়ত। পড়াশুনায় প্রচণ্ড আগ্রহ থাকার কারণে কখনো তার ক্লাস মিস যেত না। পাড়ার সুন্দরী মেয়ে বলে এই পর্যন্ত অনেক ছেলেই acidতার পিছু ছিল নিজ নিজ ভালবাসার কথা ব্যক্ত করার আশায়। কিন্তু তাতে আফরিন কখনো কোন সাড়া দিত না। পড়াশুনা-ই ছিল তার ধ্যান।যখন তার নবম শ্রেণীর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছিল তখন সে স্থানীয় এক চেয়ারম্যানের বখাটে ছেলে অপুর নজরে পড়ে। এরপর থেকে প্রতিদিন অপু তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে আফরিনকে স্কুল যাওয়া আসার পথে বিরক্ত করত। কখনো পথরোধ করে দাঁড়িয়ে রেখে নানা রকম অশ্লীল কথাবার্তা বলত। আফরিন ভয়ে কাঁপতে থাকত এবং কিছু না বলে তাদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। এই ভাবে প্রায় এক মাসের মত চলতে থাকে।
আফরিন যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকে সে প্রতিদিনের এসব ঘটনা জানাল। কিন্তু চেয়ারম্যানের ছেলে বলে তিনি ভয়ে তেমন কোন ব্যবস্থা তো নিলেনই না বরং উল্টা আফরিনকে ভদ্রভাবে স্কুলে আসা যাওয়ার উপদেশ দিয়ে দিলেন। সেই দিন সে খুব হতাশ হয়ে ফিরে যায়। লাভ হবে না মনে করে আর অন্য কাউকে বলেনি।
একদিন আফরিন স্কুল যাচ্ছিল। ঠিক এমন সময় অপুর তার দুই বন্ধুকে নিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে বিয়ে জন্য প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে আফরিন রাজী হয় না এবং অপু যাতে তাকে আর বিরক্ত না করে তা নিয়ে কথা কাটাকাটি করে। এতে অপু প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং তাকে দেখে নিবে বলে শাসাতে শাসাতে চলে যায়। এরপর থেকে আফরিনের স্কুলের আসা যাওয়ার পথে অপু কিংবা তার বন্ধুদের আর দেখা যায়নি।
অপরদিকে অপু তার বখাটে বন্ধুদের সাথে এই পরিকল্পনা আঁটতে থাকে যে কিভাবে আফরিনের রূপের সৌন্দর্য বিলীন করে দিতে পারবে।
সেই দিন ছিল অমাবস্যার রাত। আফরিন তার নিজ ঘরে কুপি জ্বালিয়ে পড়ছে। পড়া শেষে ঘুমিয়ে পড়ল নিজের রুমে। রুমের সাথেই ছিল ছোট্ট একটা জানালার মত খোলা জায়গা যেখান দিয়ে বাতাস চলাচল করতো রুমের ভেতর। আর ঘাতকরা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়।
হঠাৎ আফরিন চিৎকার দিয়ে উঠে এবং যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। পাশের রুম থেকে তার ছোট ভাই ও মা দৌড়ে আসে। পাশের বাসার লোকজনও ছুটে আসে। কিন্তু ততক্ষণে অমাবস্যার রাতে আফরিনের জীবনও অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে ডুবে যায়। তার ভাই ও মা দ্রুত তাকে নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে গেল। আর ঘাতকরা পালিয়ে যায়।
ঘাতকদের নিক্ষেপ করা এসিডে তার সম্পূর্ণ মুখ, ডান পাশের গলা ও ডান হাতের কিছু অংশ একেবারে ঝলসে যায়। কাতরাতে কাতরাতে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
আফরিনের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। তার পরও সে বেঁচে যায়। কিন্তু সেই দিনের সেই অমাবস্যার অন্ধকার তাকে ছেড়ে যায়নি। তার চোখ দুটি নষ্ট হয়ে যায়। মুখের অবয়ব সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে যায় যা না দেখলে বুঝার উপায় নেই যে কতটা ভয়ঙ্কর ছিল সেই এসিডের তীব্রতা।
এরপর এসিড অপরাধ দমন আইনে আফরিনের মা থানায় মামলা করেন। সন্দেহভাজন আসামীদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হল। কিন্তু যথার্থ সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে আদালতে তাদের অপরাধ প্রমাণ করা গেল না। অথচ আফরিন ঠিকই কিছু নর-পশুর হিংসার বলি হল। তার জীবন নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেল এসিডের তীব্র ছোবলে।
প্রচলিত আইনে আছে, যদি কোন ব্যক্তি কোন এসিড দ্বারা অন্য কোন ব্যক্তিকে এমনভাবে আহত করেন যার ফলে তার দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নষ্ট হয় বা মুখমণ্ডল, স্তন বা যৌনাংগ বিকৃত বা নষ্ট হয় তা হলে ঐ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকার অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। (এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২, ধারাঃ ৫ক)
আর শরীরের অন্য কোন অংগ, গ্রন্থি বা অংশ বিকৃত বা নষ্ট হয় বা শরীরের কোন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হন তা হলে ঐ ব্যক্তি অনধিক চৌদ্দ বছর কিন্তু অন্যুন সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। (এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২, ধারাঃ ৫খ)
পাঠক, সংশ্লিষ্ট সবাই তখন বুঝতে পেরেছিল যে কে বা কারা এবং কেন আফরিনের উপর এসিড ছুঁড়েছিল। কিন্তু হয়ত প্রভাবশালী মহলের প্রভাবে কিংবা আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সেই দিন ঐ সব অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়।
এসিড নিক্ষেপ করা বা নিক্ষেপের চেষ্টা করার শাস্তির ব্যাপারে আইনে আরো বলা আছে, যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির উপর এসিড নিক্ষেপ করেন বা করবার চেষ্ট করেন তা হলে তার ঐরূপ কাজের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক বা অন্য কোনভাবে কোন ক্ষতি না হলেও তিনি অনধিক সাত বছর কিন্তু অন্যুন তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। (এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২, ধারাঃ ৬)
অপরাধে সহায়তার শাস্তির ব্যাপারে আইনে বলা আছে, যদি কোন ব্যক্তি উপরে উল্লেখিত কোন অপরাধে সহায়তা করেন এবং সেই সহায়তার ফলে ঐ অপরাধ সংঘটিত হয় বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টা করা হয় তা হলে ঐ অপরাধ সংঘটনের জন্য বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টার জন্য নির্ধারিত দণ্ডে সহায়তাকারী ব্যক্তি দণ্ডনীয় হবেন। (এসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২, ধারাঃ ৭)
সর্বশেষে, যদি কোন ব্যক্তি এসিড দ্বারা অন্য কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান তা হলে ঐ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। (এসিড অপরাধ দমন আইন ,২০০২, ধারাঃ ৪)
পাঠক, এখনও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে অনেক শিশু, নারী ও পুরুষ এসিড সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালের গত ১০ মাসে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৬৪ জন। ২০১১ সালে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন ৬৭ জন।ধৃত অপরাধীদের অনেকের শাস্তি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ভুক্তভোগীর জীবনে যে যন্ত্রণা ও বিভীষিকার সৃষ্টি হয় সেই কষ্ট কতটা অসহনীয় তা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানেন। আমরা হয়তো তার কষ্টটা কেমন তা অনুভবের চেষ্টা করতে পারি মাত্র। আর সেই সাথে এই ধরণের অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি ও এসিড দগ্ধদের পাশে দাঁড়াতে পারি।
লেখকঃ সভাপতি, হিউম্যান রাইটস স্টুডেন্ট কাউন্সিল,
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন, বি.এইচ.আর .এফ. (চট্রগ্রাম শাখা)